
পেঁয়াজ–রসুনের মৌসুমে আশার চাষ, সার সিন্ডিকেটে কৃষকের দীর্ঘশ্বাস
মো. আমির হামজা, বিশেষ প্রতিনিধি | নাটোর
রোদে পোড়া খোলা মাঠ। শক্ত মাটির ওপর বসে এক কৃষক ও তার কিশোর সন্তান হাতে হাতে পেঁয়াজের কোয়া রোপণ করছেন। পাশে একটি ধাতব বাটিতে রাখা বীজ। নীরব অথচ মনোযোগী এই দৃশ্য নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলার পরিচিত বাস্তবতা। এখানে কৃষিকাজ শুধু ফসল ফলানোর নয়—পরিবার টিকিয়ে রাখার নিরব সংগ্রাম।
হালকা শীত, ভোরের কুয়াশা আর কোমল রোদে নাটোরজুড়ে শুরু হয়েছে পেঁয়াজ ও রসুনের মৌসুম। লাঙল–জোয়াল আর কোদালের শব্দে মুখর হয়ে উঠেছে গ্রামবাংলা। নতুন মৌসুম মানেই কৃষকদের চোখে নতুন স্বপ্ন—ভালো ফলন, ন্যায্য দাম আর সংসারে স্বস্তি।
জেলার বিভিন্ন এলাকায় এখন চাষাবাদের ব্যস্ততা চোখে পড়ার মতো। কেউ জমি প্রস্তুত করছেন, কেউ বীজতলা বানাচ্ছেন, আবার কেউ স্ত্রী–সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে পেঁয়াজ ও রসুনের কোয়া রোপণে ব্যস্ত।
কৃষকরা জানান, এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় আগাম চাষে আগ্রহ বেড়েছে। সময়মতো চাষ করা গেলে ফলন ভালো হয় এবং বাজারেও তুলনামূলক ভালো দাম পাওয়া যায়—এই প্রত্যাশাই তাদের মাঠে নামিয়েছে।
গুরুদাসপুর উপজেলার কৃষক শাহীন আলম বলেন,
“গত বছর পেঁয়াজের দাম ভালো ছিল। তাই এবার জমির পরিমাণ বাড়িয়েছি। আবহাওয়া ঠিক থাকলে লাভের আশা করছি।”
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে নাটোর জেলায় কয়েক হাজার হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ ও রসুন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। উন্নত জাতের বীজ ব্যবহার, সঠিক সময়ে সার প্রয়োগ এবং রোগবালাই দমনে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. হাবিবুল ইসলাম খান বলেন,
“চলতি মৌসুমে নাটোরে পেঁয়াজ ও রসুনের ভালো ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা মাঠপর্যায়ে নিয়মিত মনিটরিং করছি, যাতে কৃষকরা নির্ধারিত দামে ও সঠিক ওজনে সার পান। ডিলারদেরও তদারকি করা হচ্ছে।”
তবে মাঠের এই কর্মচাঞ্চল্যের মাঝেই কৃষকদের কণ্ঠে শোনা যাচ্ছে দীর্ঘশ্বাস। অনেক কৃষক অভিযোগ করেছেন, ডিলারদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সার পাচ্ছেন না। ডিলার পর্যায়ে অনিয়ম, খুচরা বাজারে অতিরিক্ত দাম এবং ওজনে কম দেওয়ার কারণে ছোট ও মাঝারি কৃষকেরা পড়েছেন চরম সংকটে।
নলডাঙ্গা উপজেলার কৃষক মো. কামাল হোসেন বলেন,
“ডিলাররা তাদের পছন্দের লোকদেরই সার দিচ্ছে। চার বিঘা জমি থাকলেও সার না পেয়ে ঠিকমতো চাষ করতে পারছি না। খুচরা বাজারে বস্তাপ্রতি ২২০০ টাকা দিতে হয়, যা সরকারি দামের চেয়ে প্রায় এক হাজার টাকা বেশি, তাও আবার ওজনে ৪–৫ কেজি কম।”
একই উপজেলার কৃষক নুর মোহাম্মদ বলেন,
“পেঁয়াজ চাষে সার ছাড়া চলে না। কিন্তু সাধারণ কৃষক সার পায় না। বছরে একবার ভালো ফলন না হলে সংসার চালানোই কঠিন।”
কৃষকদের আশঙ্কা, সময়মতো সার সংকট নিরসন না হলে পেঁয়াজ ও রসুনের আবাদ ব্যাহত হবে। এর প্রভাব পড়তে পারে বাজারেও—সরবরাহ কমে গেলে দাম বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কৃষকদের দাবি, সার বিতরণে ডিলারদের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে, উপজেলা প্রশাসন ও কৃষি বিভাগের মাঠপর্যায়ের নজরদারি বাড়াতে হবে এবং খুচরা বাজারে অতিরিক্ত দাম ও ওজনে কম দেওয়ার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
সব মিলিয়ে, নাটোরের মাঠে শুরু হওয়া পেঁয়াজ–রসুনের এই মৌসুম শুধু চাষাবাদের গল্প নয়—এটি কৃষকের ঘাম, শ্রম আর টিকে থাকার সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। মাঠে আশার চাষ চললেও সার সিন্ডিকেটের বাস্তবতায় কৃষকের দীর্ঘশ্বাস আরও গভীর হচ্ছে।