“অনুকাব্য”
✍️: তানজিলা আক্তার
অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির বক্তব্য ছিলো: পরিচয় জানলে ভালোবাসবেন..? প্রতিউত্তরে : হ্যাঁ, খুব ভালোবাসবো। হৃদয়ের রাণী করে রাখবো।
তাই একটা গিফটের সাথে নাম লিখবো বলে জানালাম ক্ষুদেবার্তায়(SMS)। ক্যাম্পাসের শহীদ মিনারের সামনে পাতাবাহারী গাছের ঝোপের ভেতরে গিফটসহ রেখে দিলাম একটি চিরকুট। রেখেই সব বন্ধুদের সাথে আমি ক্লাসে এসে আড্ডায় মনোনিবেশ করলাম। আড়চোখে তাকেই ধারণ করছিলাম আর একটা ক্ষুদেবার্তায় লিখে দিলাম শহীদ মিনারের সামনে পাতাবাহারী গাছের ঝোপের কাছে তোমার উপহার। আড্ডার ঘোরেও আমি জানালার দিকে পিঠ দিয়ে ফোনের গ্লাসে দেখছিলাম সে শহীদ মিনারের কাছে এসে গিফটা দেখে মুচকি হাসি দিয়ে চিঠিটা পড়লো: প্রিয় ভালোবাসা, এটা নব্বই দশক নয় তবুও হাতে লিখলাম। আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি।পরিচয় দিতে ভয় পাই। কারণ শুনেছি ভালোবাসা প্রকাশ করে দিলে মানুষটা সস্তা হয়ে জায়, অবহেলা করা হয়। আমি আপনার অবহেলা সহ্য করতে পারবো না। আমি অত্যন্ত দুঃখিত তাই আমি আপনার অপরিচিতা হয়েই থাকতে চাই। ইতি আপনার অপরিচিতা। কখনোই পরিচয় দেয়নি তাই সে আমাকে অপরিচিতা বলে ডাকতো। সেই চিঠিটা পাওয়ার পরে সে প্রচুর রাগান্বিত হলো। আমি তাকে বলে দেই আপনাকে ভয় পাই আমি। আপনি যেন যমদূত, কাছে আসলে আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে জায়।
আমি বেখেয়ালি হয়ে জাই তখন। তাই ভয়ে পরিচয় দেয়নি। আপনাকে হারানোর ভয়। আমি আপনাকে হারাতে চাই না। আমি জানতাম এক ইয়ারে দুইশত পঁয়তাল্লিশ শিক্ষার্থীদের মধ্যে একশত আটাত্তর জন মেয়ের ভেতরে একজন মেয়েকে খুজে বের করা খুবই কষ্টসাধ্য। তবুও সে আমাকে বলে দিল তুমি অনু তাই না। আমি জানতাম সে আমাকে চিনবে। তবুও আমি চাইতাম না পরিচয় জেনে ভালোবাসার অবহেলা করুক। সত্তিটা এমন যে, আপনি মানুষকে আপনার দুর্বলতা জানিয়ে দিলে সে সেই জায়গাতেই আঘাত করবে এবং ক্ষত-বিক্ষত করে রক্ত ঝরাবে বরংবার। তাই ভালোবাসার মানুষকে ভালোবাসি বলাতে আমার শত বাধা, ভয় আর শংশয়। অবহেলার থেকে শ্রেয় প্রিয় মানুষটাকে লুকিয়ে দেখা।তাকে একার দেখার লুকিয়ে কি মজা, সেতো আমি ছাড়া কেউ জানে না…! যে পালিয়ে বেড়ায় সে কেমন ভালোবাসে? কিসের ভালোবাসা? এ ক্ষণ আবেগ।ভালোবাসলে সামনে আসো।পালিয়ে বেড়ায় কাপুরুষ। আমি তোমাকে সাহসী মনে করতাম।যাই হোক, তোমাকে দুইদিন সময় দিলাম পারলে পরিচয় দিবা নাইলে চিরতরে ফেসবুক থেকে ব্লক এবং জীবন থেকেও চিরতরে হারাবে তোমার ভালোবাসাকে, হারাবে তোমার প্রিয়তমকে। কথা দিলাম, তুমি যেই হও আমি তোমাকে ভালোবাসবো,,এটা বলেই অফ্লাইনে চলে গেলো। রাতে স্তব্ধতা আমাকে খুঁড়ে খুঁড়ে চর্বণ করছে। আমিও গোগ্রাসে গিলছি স্তব্ধতাকে। আজ একদিন অতিক্রম হলো। কাল ১৯ আষাঢ়।
ভেবে চিনতে মনোস্থির করলাম ভাগ্যে যা আছে তাই হবে… বলব হৃদয়ের সব কথা। সকাল থেকে মুষলধারে বৃষ্টি। ক্যাম্পাসে কেউ নেই বৃষ্টির জন্য। ক্যাম্পাস যেন বৃষ্টি লিলারুপ লাবণ্যে মুখরিত। আমি ক্ষুদেবার্তায় জানিয়েছিলাম, আমি তোমাকে হারাতে চাই না। এসো শহীদ মিনারটির সামনে। নিজেকে আড়াল করে রেখেছিলাম। যদি দূর থেকে আমাকে দেখে সে চলে জায়। বৃষ্টি বিলাশে সে শহীদ মিনারে সামনে দাঁড়িয়ে ভিজছে তখন বিকাল চারটা। স্তব্ধ চর্তুদিকে, আমি এসে দাঁড়ালাম কাব্যের সামনে। বৃষ্টি যেনো কাব্যের সৌন্দর্য দ্বিগুণ করেছে। আমি সব ভয় অতিক্রম করে বললাম: “আমি আপনার অপরিচিতা। কাব্যে আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি।” তখন কাব্যের হাসিমুখটা আমার ভেতর আত্মবিশ্বাস এর জন্ম দিয়েছিলো তাই অপেক্ষা না করি হৃদয়ের কথা জানিয়ে দিলাম। কবে থেকে শুরু হলো এসব?এত ভালোবাসার জন্ম কিভাবে?বলোতো শুনি? – কাব্যের এ কথায় আত্মবিশ্বাস দ্বিগুন হলো।শুরু করলাম অব্যক্ত স্মৃতি চারণ: ভালোলাগা বা ভালোবাসা একদিনে হয় না আমারো হয়নি।আপনাকে দেখতে ভালো লাগে। আমার এ দু’নয়ন আপনাকে খুজে বেড়ায় সারাক্ষণ।
আপনার দিকে সারাক্ষণ অপলক তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।আপনি অন্য মেয়ের দিকে তাকালে আমার হৃদয়ের রক্তক্ষরণ আরম্ভ হয়। আপনার আমার প্রতি দুর্বলতাটা আমি বুঝতে পারি। আপনিও ক্লাসের মধ্যে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন। আপনার চোখের ভাষা অসীম। ওই চোখেই বুঝতে পেরেছিলাম আপনার অব্যক্ত কথন। পরোক্ষণ থেকেই আপনাকে দেখতে দেখতে আমার প্রতিটা ক্লাস অতিক্রম হয়। এখন আর পড়তে ভালোলাগে না, সারাক্ষণ আপনাকে দেখতেই মন চায়।আপনাকে দেখতে ভাল্লাগে আপনার চুলগুলো বাতাসে যখন হালকা দোল খায় আমার হৃদয়ে উথাল-পাথাল শুরু হয়। আপনি আমার প্রথম আর শেষ ভালোবাসা কাব্য। আপনাকে আমি খুব ভালোবাসি। অনুভবে শুধুই আপনি। আপনি বলেছিলেন যে পরিচয় দিলে ভালোবাসবেন..! প্রতিউত্তরে : দুঃখিত। সম্ভব না। অশ্রুসিক্ত নয়নে বৃষ্টিমুখরিত শহীদ মিনারের সামনে কাব্যের দু’টি পা জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম ভালোবাসি আপনাকে। বাঁচবো না আমি আপনাকে ছাড়া। রেখে দেন আপনার করে। প্রতিউত্তরে: বুদ্ধি বিকাশিত হয়নি তোমার, কে ভর্তি নিলো এখানে তোমার? তোমার রেজাল্ট এবার কি? ফেল করেছো দ্বিতীয় বর্ষে। ইম্প্রুভমেন্ট দিয়ে পাশ করবে ছি এমন মেয়েকে নিজের পাশে কল্পণাতেও আমার ঘৃণা লাগছে।আগে নিজে যোগ্য হও তারপরে ভালোবাসতে এসো।সাহস হয় কি করে? এই কাব্যসেন কে প্রস্তাব দেওয়ার…..
পরবর্তীতে আমার দিকে আর তাকাবেও না তাহলে আমি এই প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চিরতরে চলে জাবো,কথাটা মনে রেখো অনু। কাব্যের খুব অহংকার দ্বিতীয় বর্ষে ক্লাস ইনকোর্সে উত্তীর্ণ হয়েছে বলে, আমিও প্রথম বর্ষে ফাস্ট ডিভিশণে উত্তীর্ণ হয়েছিলাম। সেই বৃষ্টিমুখরিত শহীদ মিনারের সামনে দাঁড়িয়ে দু’ঘন্টা অজস্র চোখের পানি ঝরিয়ে। হঠাৎ মনে হলো,বৃষ্টির পানির কাছে তুচ্ছ এ চোখের পানি। বৃষ্টিকে প্রশ্ন করতে লাগলাম আপনার বুকে ঠিক কতখানি কষ্ট জমা হয়েছে? সেদিন থেকে আমার লড়াই শুরু। আমাকে দ্বিতীয় বর্ষেও ফাস্ট ডিভিশণ পেতে হবেই। আমি কাব্যের দিকে আর কখনোই তাকাইনি। দ্বিতীয় সেমিস্টারেও প্রথম হলাম। অতঃপর আমি শহীদ মিনারের দক্ষিণ পার্শ্বে শিউলি গাছের সবচেয়ে নিচু ডালটায় নিজ হাতে সেলাই করা রুমালটা কাব্যের জন্য বেধে রেখেছিলাম। রুমালে লিখেছিলাম- আমি ফাস্ট ডিভিশণ পেয়েছি, রুমাল নিয়ে আমার ভালোবাসা গ্রহণ করো… বছরটা ঘুরে গেলেও রুমালটা নেয়নি। আজও শিউলি গাছে বাঁধা।বছর ঘুরে তৃতীয় সেমিস্টারেও প্রথম। সত্যি অনেক ভাবায় সেই দিনটা যেদিন কাব্যের অবহেলায় আমার নতুন জীবনটা শুরু হয়েছিলো। কি অদ্ভুত তাইনা? যাকে পাহাড় সমান ভালোবাসলাম সেই পাহাড়ের দ্বিগূন ঘৃণা প্রতিদান দিলো। স্পষ্ট এটাই যে শুধু অপরিচিতার সাথে পরিচিত হওয়ার জন্যই বলেছিলো পরিচয় দিলে ভালোবাসবে। কথা দিয়ে কথা রাখেনি বরং অপমান করেছে। আরও একটি বছর কেটে গেলো কালকে ফাইনাল ইয়ারের ফলাফল দিবে। বারোটায় রেজাল্ট দিবে খুব উত্তেজনা কাজ করছে। মন ব্যাকুল হয়ে আছে ফলাফল এর দুশ্চিন্তাতে। বারোটা বেজে গেলো ঝিরিঝিরে বৃষ্টি।
নোটিশ বোর্ডে দেখলাম আমি ফাস্ট ডিভিশণ পেয়েছি। আমার জীবনে আজ সব থেকে খুশির দিন। কেউ একজন রঙ নাম্বারে জানালো আজ বিকাল চারটায় শহীদ মিনারের সামনে আসবে? হঠাৎ ভাবলাম কাব্য নয়তো! ভাবতেই হাসি পেলো….তিন বছরেও যে রুমালটাই গ্রহণ করলো না। সে কি না ফোন করতে যাবে আসলেই হাস্যকর। ভালোবাসা এখন আর বুকের ভেতরে উথাল-পাতাল করে না।এখন আর আগের মতো হুটহাট সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি না। ক্যাম্পাসের শহীদ মিনারটা আমার ভীষণ প্রিয়। হাজার হাজার স্মৃতি বিজড়িত। ভাবলাম জাই প্রাণপ্রিয় ক্যাম্পাস আর শহীদ মিনারটা ঘুরে আসাও হয়ে যাবে। বৃষ্টি হচ্ছে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। শহীদ মিনারের ওইখানে কাব্যকে দেখে আমি দ্রুত প্রস্থান করতে ব্যস্ত।তখন পেছন থেকে কাব্য হাত টেনে ধরে বললেন ভালোবাসি শুধু তোমাকেই। আমি যেদিন প্রথম তোমাকে দেখেছিলাম সেদিন থেকেই তোমাকে ভালোবাসতাম। কাব্যের এই হৃদয়ে শুধুই অনু।ভাবছিলাম ফাইনাল ইয়ারের পরেই জানাবো তোমাকে।
আজ তুমি ফাইনাল ইয়ারেও ফাস্ট হয়েছো। আমার মিশন সাকসেসফুল। আমি জিতে গেছি। আমার অনু ভালোবাসার মোহে সুন্দর জীবনটাকে হারিয়ে ফেলবে আমি তা চাইছিলাম না।তাই আমার অনুর সুপ্ত ভালোবাসায় জলন্ত অগ্নিশিখার স্ফুলিঙ্গের সৃষ্টি করেছিলাম। অনু তুমি ক্ষমা করে দেও আমাকে,আমিও ভালোবাসি শুধু তোমাকে। পরোক্ষণেই ওর বুদ্ধিটা আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেলো,বুঝতে পারলাম সত্তিকারের ভালোবাসা আর ভালো চাওয়ার মানুষটা ঠিক কাব্যের মতোই হয়। আমিও আপনাকেই ভালোবাসি কাব্য।কাব্য আজ একবার জড়িয়ে ধরবেন আমাকে। বলতেই কাব্যের বুকের সাথে আমাকে জড়িয়েই বলে উঠলেন, এই বুকটা শুধু আমার অনুর লিখিত দলিল। পরোক্ষণেই দেখলাম শহীদ মিনারের সামনে ফাকা জায়গাটায় মোমবাতি দিয়ে লাভ অঙ্কিত। ঝিরিঝিরে বৃষ্টিতে মোমবাতি নিভোজ্জ্বল দৃশ্যটা মনোমুগ্ধকর। লাভের ভেতরে ছোট্ট করে মোমবাতি দিয়েই লেখা “অনুকাব্য”