মোঃ রিয়াজ উদ্দিন, হাতিয়া (নোয়াখালী) প্রতিনিধিঃ
বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা হাতিয়া, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সম্ভাবনার পাশাপাশি এখানে আছে ক্ষমতার জটিল খেলা। স্বাধীনতার পর থেকে এ অঞ্চলের রাজনীতি বারবার পাল্টেছে রঙ, মুখ, স্লোগান, কিন্তু পাল্টায়নি সাধারণ মানুষের ভাগ্য। দল বদল, ব্যক্তি পূজা, এবং অর্থ-প্রভাবের রাজনীতি আজও গিলে খাচ্ছে জনস্বার্থকে। তারা বলছে, হাতিয়ার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট দেখলে বোঝা যায় এখানে মতাদর্শের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থ, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এবং অর্থনৈতিক প্রভাব বেশি কাজ করে। যতদিন না রাজনীতি সত্যিকার অর্থে জনগণকেন্দ্রিক হবে, ততদিন হাতিয়ার উন্নয়ন শুধু বক্তৃতা ও পোস্টারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।
জানা যায়, হাতিয়ার রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে আধিপত্য বিস্তার করছে দুটি বড় রাজনৈতিক দল—আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। তবে স্থানীয় পর্যায়ে নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিরা অনেক সময় দলের আদর্শের চেয়ে নিজের প্রভাব ও স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেন।
তথ্য পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত নানা রাজনৈতিক মোড় ও বিতর্কের সাক্ষী। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে এখানে দায়িত্ব পালন করেছেন একাধিক সাংসদ, যাদের মধ্যে কেউ উন্নয়নমূলক কাজের জন্য প্রশংসিত হয়েছেন, আবার কেউ দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও চাঁদাবাজির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন বার বার।
এর মধ্যে ১৯৭৩ – হাতিয়ায় (আওয়ামী লীগ)
স্বাধীনতার পর প্রথম নির্বাচিত সাংসদ ছিলেন মো. হানিফ।
১৯৮১-১৯৮২ আমিরুল ইসলাম কালাম মৎস্য ও পশুপালন প্রতিমন্ত্রী এবং ত্রাণু পূর্ণবাসন প্রতিমন্ত্রী। হাতিয়ার মানুষ মনে করে হাতিয়ার রাজনীতিতে সফল একজন মানুষ স্থানীয়রা আরো জানায় আমিরুল ইসলাম কালামের কথা হাতিয়ার মানুষ আজীবন মনে রাখবে।
১৯৭৯ – বোরহান উদ্দিন (বিএনপি)
তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন।
১৯৮৬- ১৯৯০ – মোহাম্মদ আলী (জাতীয় পার্টি/পরে আওয়ামী লীগ) এ সময় রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলেন মোহাম্মদ আলী। পরবর্তীতে ২০০১–২০০৬ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেও সাংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০২৪ সালের ১১ আগস্ট তিনি স্ত্রী ও সন্তানসহ নৌবাহিনীর হেফাজতে যান। তাঁর বিরুদ্ধে স্থানীয় পর্যায়ে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির গুরুতর অভিযোগ ওঠে।
পরবর্তীতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাঁর বিদেশযাত্রা নিষিদ্ধ করে এবং সম্পদ নিয়ে তদন্ত শুরু করে।
১৯৯১- ১৯৯৬ – মো. ওয়ালী উল্লাহ (আওয়ামী লীগ)
হাতিয়া দ্বীপের বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ওয়ালী উল্লাহ ছিলেন বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠতম সহকর্মী এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন হাতিয়া দ্বীপের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার। এছাড়া জনসেবায় সম্পৃক্ত থেকে নলচিরা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এবং পরবর্তী সময়ে ২০০৯ সালে হাতিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। হাতিয়া ডিগ্রি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও দীর্ঘ সময় উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন বলে জানা যায়।
১৯৯৬ – মোহাম্মদ ফজলুল আজিম (বিএনপি)
একজন সফল শিল্পপতি ও রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত আজিম গ্রুপের মালিক মোহাম্মদ ফজলুল আজিম। পরবর্তীতে ২০০৮–২০১৪ সালেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে এমপি ছিলেন। বড় আকারে সরকারি বা দুদক তদন্তের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। স্থানীয়রা বলছেন মোহাম্মদ ফজলুল আজিমের শাসন আমলেই হাতিয়ার ইতিহাসে স্বর্নযুগ বলা হয়। হাতিয়ার প্রতিটি সেক্টরে তার উন্নয়নের ছোঁয়া রয়েছে।
২০১৪ -২০২৪ – আয়েশা ফেরদৌস (আওয়ামী লীগ)
প্রায় এক দশক এমপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করা আয়েশা ফেরদৌসের বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের শেষ দিকে দুদক তদন্ত শুরু করে। অভিযোগ ছিল, অবৈধ সম্পদ অর্জন, ক্ষমতার অপব্যবহার ও প্রভাব খাটিয়ে বিপুল সম্পত্তি গড়ে তোলার। জাতীয় গণমাধ্যমে এ নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
২০২৪- বর্তমান মোহাম্মদ আলী (স্বতন্ত্র)
দ্বিতীয়বারের মতো এমপি হলেও আগের অভিযোগ থেকে মুক্তি পাননি। নৌবাহিনীর হেফাজত, স্থানীয় অভিযোগ ও দুদক তদন্ত এখনো তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। হাতিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাস প্রমাণ করে, এখানে নেতৃত্বের সঙ্গে উন্নয়ন ও অনিয়ম, দুই চিত্রই বিদ্যমান। কেউ উন্নয়নে প্রশংসিত হয়েছেন, আবার কেউ নানা অভিযোগে কালিমালিপ্ত হয়েছেন।
স্থানীয়রা বলেন, নির্বাচনের আগে প্রতিশ্রুতি, নির্বাচনের পর ভাটা এ যেন হাতিয়ার রাজনৈতিক সংস্কৃতির চিরাচরিত চিত্র। দল বদল আর স্বার্থান্বেষী জোট বাঁধা এখানে নিয়মিত ঘটনা।
অবকাঠামো উন্নয়ন, নদীভাঙন রোধ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা
এসব ইস্যুতে দলগুলো নির্বাচনী সময়ে যতটা সরব, নির্বাচনের পর ততটাই নীরব হয়ে যায়।
পদ বাণিজ্য, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ ও চাঁদাবাজি রাজনীতিকে কলুষিত করেছে। প্রভাবশালী নেতারা অনেক সময় আইনের ঊর্ধ্বে থেকে নিজেদের আখের গোছানোকেই মূল লক্ষ্য বানান। স্থানীয় যুব ও ছাত্র সংগঠনের বড় অংশ রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থেকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে, যা সাধারণ জনগণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে।
জানা যায়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হাতিয়া আসন (নোয়াখালী -৬) অনেক জনের নাম এসেছে এবং সবার মুখে মুখে, প্রচার প্রচারণার বিত্তি করে মিছিল সভা মিটিং এর মাধ্যমে জানা গেছে এমপি পদপ্রার্থী হিসেবে ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা মনোনয়ন চাইবেন, উল্লেখ যোগ্য কয়েকজনের মধ্যে বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম, হাতিয়া উপজেলার সাবেক বিএনপির সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী তানভীর উদ্দিন রাজিব, এক সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র দলের উজ্জ্বল নক্ষত্র শাহনেওয়াজ।
এছাড়াও জুলাই আন্দোলনের বিপ্লবী সাহসী যোদ্ধা জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ। বাংলাদেন জামায়াতে ইসলামীর মনোনীত প্রার্থী এডভোকেট শাহ মাহফুজুল হক মূলত হাতিয়ার আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই ৫ জনই রয়েছেন সাধারণ জনগণসহ অলিগলি চায়ের দোকানের আলোচনায়।
নিম্ন বিত্ত সাধারণ মানুষের দাবী হাতিয়ার অপরাজনীতি চিরতরে বন্ধ হোক, রাজনীতি হোক সাধারণ মানুষের কল্যাণে। সকল রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিরা হাতিয়ার উন্নয়নে কাজ করুক সাধারণ মানুষই খুঁজে নিবে কাকে তাদের নেতা বানাবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাতিয়ার সনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক বলেন, রাজনীতি এখন মানুষের সেবা নয়, বরং ক্ষমতার দখল ধরে রাখার প্রতিযোগিতা। সাধারণ মানুষের কথা শুধু ভোটের সময় সকল রাজনৈতিক নেতাদের মনে পড়ে।
দল বদল এখানে খুব সাধারণ ঘটনা। যে দল ক্ষমতায় থাকে, সবাই তার পতাকাতলায় চলে যায়, জনগণের স্বার্থে কেউ লড়াই করে না।
আমাদের নদী ভাঙে, ঘরবাড়ি যায়, কিন্তু বড় বড় নেতারা শুধু প্রতিশ্রুতি দেন। এরপর তাদের দেখা পাওয়া যায় না।
যুবরাজনীতিকে রাজনৈতিক নেতারা ব্যবহার করেন ক্ষমতার হাতিয়ার হিসেবে। এতে তরুণ প্রজন্ম নষ্ট হচ্ছে, আর সমাজে ভয় তৈরি হচ্ছে।
জনগণ এখন অনেক সচেতন। যারা উন্নয়ন করবে না, হাতিয়ার আপামরসাধারণ জনগণের কল্যাণে কাজ করবে না, দুর্নীতি করবে, তাদের অবস্থা ও আওয়ামী লীগের মতোই হবে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, নিয়মিত জবাবদিহিতা ও দুর্নীতি দমন কার্যক্রম সক্রিয় থাকলে এই আসনের রাজনৈতিক পরিবেশ আরও স্বচ্ছ হতে পারে বলে মনে করেন তারা।